খুলনার পর বহুল আলোচিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও বিপুল ভোটে বিজয়ী হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম। রাত ২টা ১৫ মিনিটে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলম ১ লাখ ৮৫ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছেন। ৩৪৫ কেন্দ্রে তিনি পেয়েছেন ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার পেয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৮৫৫ ভোট। মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২৫। এর মধ্যে ভোট বন্ধ রয়েছে ৯টি কেন্দ্রে।
বিএনপি অভিযোগ করেছে, গাজীপুরে অভিনব কৌশলে ভোট ডাকাতির মহোৎসব হয়েছে। চারশ কেন্দ্রেই অনিয়ম হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এটা বিএনপির পুরনো অভ্যাস। তাদের অভিযোগের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। নির্বাচন কমিশনের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ব্যালট পেপার ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ৯ কেন্দ্রে ভোট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে বিপুল ভোটে বিজয়ের পর রাতে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাজীপুরবাসী বিশ্বাস করে আমাকে ও নৌকা প্রতীকে রায় দিয়েছে। আমি তাদের বিশ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা করব। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জনগণকে দেওয়া সব ওয়াদা পূরণ করব। আমি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই।’ তিনি নেতা-কর্মীদের আনন্দ-উল্লাস না করে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানান।
মেয়র পদে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু গোলযোগের খবর পাওয়া গেছে। তবে বেশ কয়েকটি স্থানে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৫৭টি ওয়ার্ডে ২৫৬ জন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থী ছিলেন। অনেক বেশি প্রার্থী হওয়ায় ভোটের সময় প্রায় সব ওয়ার্ডেই কম-বেশি উত্তাপ ছড়ায় কাউন্সিলর সমর্থকদের দ্বন্দ্বে।
নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পৌনে ১১টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ভোটারদের অভিযোগ, দুই কাউন্সিলর প্রার্থী হান্নান মিয়া নান্নু ও আবদুল করিমের কর্মীরা বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তারা বলেন, ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। এ তথ্য ছড়িয়ে পড়লে বাইরে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
দুপুর সোয়া ৩টার দিকে নগরীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাক্রাউরি মাদ্রাসা ও এতিমখানা কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ কেন্দ্রের ১ নম্বর বুথে দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থীর সব ব্যালট শেষ হয়ে যায়। তখনো মেয়র ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের ব্যালটে ভোটদান বাকি ছিল। এ সময় এক কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকরা ফাঁকা গুলি ছোড়ে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। উপস্থিত ভোটাররা জানান, কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ আলী ও পাঞ্জর আলীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পাঞ্জর আলীর ছেলে মাসুদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আবদুল মজিদ নামের একজন ভোটার জানান, মোহাম্মদ আলীর লোকজন ব্যালটে সিল মারে। তার সমর্থকরা জয়নালের দোকান ভাঙচুর করে। এ ছাড়া আরও কয়েকজন আহত হন বলে তিনি জানান। পুলিশ জানায়, পাঞ্জর আলীর ছেলের নেতৃত্বে নৌকার মিছিল নিয়ে ভোট কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করা হয়। এ জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে সময় পার্শ্ববর্তী আরেক ভোট কেন্দ্রেও কাউন্সিলর পদের ব্যালট শেষ হয়েছে বলে ভোটাররা অভিযোগ করেন।
সকাল ঠিক ৮টার দিকে গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের গাজীপুর মহিলা কলেজ কেন্দ্রে ভোটাররা ভোট দিতে আসতে শুরু করেন। কেন্দ্রের ভিতরের পরিবেশ বেশ শান্ত দেখা গেলেও বাইরে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে পরিস্থিতি শান্ত করে। ভোট কেন্দ্রে আসা বয়োবৃদ্ধ সুলতান উদ্দিন জানান, সকালে রোদ কম থাকে। তাই ভোট দিয়ে গেলাম।
পাশেই কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় অন্য চিত্র। ভোটাররা খুবই উত্ফুল্ল, তবে উপস্থিতি কম ছিল। লাইনে দাঁড়িয়ে নারী-পুরুষ ভোট দিচ্ছেন। আনু মিয়া নামে এক যুবক জানালেন, এবারের মতো সুষ্ঠু ভোট আর কখনো হয়নি। একই কথা বলেন, নারী ভোটার মাজেদা বেগম। তিনি জানান, আমাদের কেন্দ্রে কোনো ঝামেলা নেই, তাই আমরা নির্বিঘ্নে ভোট দিতেছি। ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল ৯টা ৫ মিনিট ঠিক তখন ভোট দিতে এলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম।
নিজের ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, গাজীপুরে নৌকার বিজয় হবে। উন্নয়নের প্রতীক নৌকায় আপনারা ভোট দিন, গাজীপুরেও সমানতালে উন্নয়ন হবে। কেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া ও গ্রেফতারের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। জয়-পরাজয় মেনে নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে জয়-পরাজয় যাই হোক, জনগণ যে রায় দেবে তা-ই মেনে নেওয়া উচিত।
এদিকে দুপুর ঠিক ১২টার দিকে শহরের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘেঁষা ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নাওজোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কাউন্সিলর প্রার্থী তানভীর সিরাজ ও খোরশেদ আলমের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কাউন্সিলর প্রার্থীসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউন্সিলর প্রার্থী তানভীর সিরাজ বিএনপি সমর্থিত হলেও নৌকা প্রতীকের ব্যাচ ঝুলিয়ে কেন্দ্রে ঘুরলে প্রতিপক্ষরা হামলা চালায়। তানভীরের এজেন্ট ঝর্ণা তানভীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাউন্সিলর প্রার্থী নৌকার ব্যাচ গলায় ঝুলানোর কারণে প্রতিপক্ষ খোরশেদের লোকজন এসে মারধর করে। আমি প্রতিবাদ করলেও তারা আমাকে ও সাজু সরকারকে মারধর করে। দুপুর দেড়টার দিকে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের গজারিয়া হামিদিয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের চিত্র ছিল অনেকটা ফাঁকা। ভোটারের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে কম। এদিকে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকার চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আগত ভোটারদের হাতপাখার বাতাস দিয়ে ভোট চাইতে দেখা গেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুহাম্মদ নাসির উদ্দিনের পক্ষে। ভোটারদের মন জয়ে মেয়র প্রার্থীর লোকজন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেন। মহানগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাইমাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটকেন্দ্রের ভিতরে ভোটার উপস্থিতি কম। তবে কেন্দ্রের বাইরে ছিল প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের উত্তেজনা বেশি। চান্দনা এলাকায় টিএন্ডটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে নারী ভোট কেন্দ্রে একই সঙ্গে দুই নারী ও এক পুরুষকে ভোট দিতে দেখা গেছে।
৯ কেন্দ্রে ভোট স্থগিত : অনিয়ম ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের দ্বন্দ্বের কারণে ৯ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে কোনো ধরনের অনিয়ম ছাড়াই গাজীপুরের ৪১৬টি কেন্দ্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট শেষে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ৫টা ৫০ মিনিটে নির্বাচন ভবনে এ প্রতিক্রিয়া দেন।
তিনি জানান, গাজীপুরের ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে অনিয়মের কারণে ৯টি কেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে। বাকি কেন্দ্রগুলোয় কোনো অনিয়ম হয়নি। সচিব জানান, কমিশনের নির্দেশনা ছিল— কোথাও বিন্দুমাত্র অনিয়ম পেলে বন্ধ। কমিশন বলেছিল— অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। এ জন্য অনিয়ম বরদাস্ত করা হয়নি। ৯টি কেন্দ্র ইসির সঙ্গে আলাপ করে প্রিসাইডিং অফিসার বন্ধ করে দিয়েছেন। বাকি ৪১৬টি কেন্দ্রে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং উৎসবের মাধ্যমে ভোট শেষ হয়েছে।
বিএনপি সংবাদ সম্মেলন ও কমিশনে এসে প্রায় ১০০টি কেন্দ্রে এজেন্ট বের করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, কমিশনের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা আমার জানা নেই। আমি এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোটের অনিয়ম ও ভিডিও চিত্রও এসেছে। এসব বিষয়ে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয়। ৯টি কেন্দ্রে অনিয়মের ব্যাখ্যা তুলে ধরে সচিব জানান, স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের দ্বন্দ্বের কারণে এসব অনিয়ম হয়েছে।
এদিকে বন্ধ ৯ কেন্দ্রের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো প্রিসাইডিং অফিসারদের তথ্য অনুযায়ী, দুষ্কৃতকারীরা ব্যালট পেপার ছিনতাই করে এবং ব্যালট বাক্সে জোর করে তা প্রবেশ করানোয় আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়। এ জন্য ৯ ভোট কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। ৯ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিতের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল সাংবাদিকদের বলেন, ৪২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে নয়টির ভোটগ্রহণ তারা স্থগিত করেছেন।
কেন্দ্রগুলো হলো : খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্র-১ (নং-৩৭২), খরতৈল মনসুর আলী আদর্শ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং ৩৭৩), হাজী পিয়ার আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র (নং-৩৮১), জাহান পাবলিক দত্তপাড়া টঙ্গী কেন্দ্র (নং-৩৪২), ভোগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র (নং-৯৮), কুনিয়া হাজী আবদুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-১ (নং-২৪৩), কুনিয়া হাজী আবদুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং-২৪৪), মেশিন টুলস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র-২ (নং-১৬১) এবং বিন্দান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুবাইল কেন্দ্র (নং-২৭৪)।
লড়াইয়ে ছিল সাত মেয়র প্রার্থী : গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে ৭ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৫৬ জন (৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৮৪ জন প্রার্থী। মেয়র প্রার্থীরা হলেন— আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (নৌকা), বিএনপির মো. হাসান উদ্দিন সরকার (ধানের শীষ), ইসলামী ঐক্য জোটের ফজলুর রহমান (মিনার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. নাসির উদ্দিন (হাতপাখা), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন (মোমবাতি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাজী মো. রুহুল আমিন (কাস্তে) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ (টেবিল ঘড়ি)।
এক নজরে গাজীপুর : নয় হাজার ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা। মোট ভোটার ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৯৩৫ জন এবং নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১ জন। ৪২৫টি কেন্দ্র। ভোট কক্ষ রয়েছে ২৭৬১টি।